জাহিদ রহমান : সারাদেশে এখন (২৩ এপ্রিল) পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মোটে রোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ১৮৬ জন। এ পযন্ত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন মোট ১২৭ জন।
সুস্থ হয়ে উঠেছেন অনেকেই। চীন থেকে উত্পত্তি হওয়া করোনা ভাইরাস শুধু ইউরোপ, আমেরিকা নয় এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও এখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভাইরাস যে কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে তা আমরাও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। শুরুর দিকে কম থাকলে টেস্টের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে এখন প্রতিদিনই সারাদেশে করোনাভাইরাস রোগীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত এক সপ্তাহের উর্ধ্বগতির চিত্র দেখে এটি স্পষ্ট যে এই রোগের সংক্রমণ থেমে নেই। আমাদের অজান্তেই একজন থেকে আরেকজনে ছড়িয়ে পড়ছে করোনা।
মাগুরাতে এখন পর্যন্ত মোট দুজন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত ২২ ও ২৩ এপ্রিল পরপর দুদিন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েল নমুনা পরীক্ষায় মাগুরার দুজন রোগী করোনা পজিটিভ বলে প্রমাণিত হয়। প্রথম যে রোগী শনাক্ত হন তিনি মাগুরা সদর উপজেলার আঠারোখাদা ইউনিয়নের মৃগীডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা। অপরজন মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার জোত-শ্রীপুর গ্রামের বাসিন্দা। এ দুজনই গাজীপুর এলাকাতে গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। দুজনই একসাথে গাজীপুর-আশুলিয়া থেকে আরও অন্যান্যদের সাথে একটি মাইক্রোবাসযোগে মাগুরাতে আসেন।
মাগুরার সিভিল সার্জন অফিস বলছে মাগুরা থেকে ২২ এপ্রিল সকাল পর্যন্ত ১০২ জনের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় যশোরে। এর মধ্যে ৯১ জনের নমুনা পরীক্ষার ফলাফল তারা হাতে পান। এর মধ্যে ৯০ জনের করোনা নেগেটিভ আসে।
মাগুরাতে পর পর দুই দিন দুজন রোগী করোনা শনাক্ত হওয়ার পর সোশাল মিডিয়া থেকে শুরু করে সবজায়গাতেই এই খবরটি যেনো এক মহাআতঙ্ক হিসেবে প্রচার পেতে থাকে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী আক্রান্ত দুজন তাদের নিজ নিজ বাড়িতে হোম-কোয়ারেন্টিনে আছেন। সিভিল সার্জন অফিস বলছে তারা বেশ ভাল আছেন। যদি তাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে তাহলে তাদেরকে হাসপাতালের আইসোলেশনে রাখা হবে। আর সেটা না হলে তাদেরকে বাড়িতে রেখেই চিকিত্সার পরামর্শ ও সহযোগিতা দেওয়া হবে।
মাগুরায় যে দুজনের করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে তাতে করে বুঝা যাচ্ছে এখন পর্যন্ত দুজনের কেউই সিভিয়ার বা ভয়ানক পর্যায়ে নন। দুজনই অনেকটাই প্রাথমিক লেভেলে। আশা করি সিভিল সার্জন অফিসে এ বিষয়ক সঠিক তথ্যাদি আছে।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলছেন শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য অসুস্থতার মতো করেনা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা এবং জ্বরসহ হালকা লক্ষণ দেখা দেয়।
কিছু মানুষের জন্য এই ভাইরাসের সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। এর ফলে নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট এবং অর্গান বিপর্যয়ের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। তবে খুব কম ক্ষেত্রেই এই রোগ মারাত্মক হয়। এই ভাইরাস সংক্রমণের ফলে বয়স্ক ও আগে থেকে অসুস্থ ব্যক্তিদের মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
করোনা ভাইরাস রোগ নিয়ে এত আতঙ্কের কারণ হচ্ছে এখন পর্যন্ত এর কোনো টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। চিকিত্সার শুরু হয় মূলত লক্ষণ দেখে।
আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, এই ভাইরাস শরীরে ঢোকার পর সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে ২ থেকে ১৪ দিন সময় লাগে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রথম লক্ষণ হয় জ্বর। এ ছাড়া শুকনো কাশি বা গলাব্যথা হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, না, জ্বর, কাশি হলেই হাসপাতালে যাওয়ার দরকার নেই। কারণ এই রোগ খুবই সংক্রামক। আগে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন আপনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিনা । এরপর চিকিত্সকের পরামর্শ মেনে চলুন।
আমাদের সবার তাই মনে রাখতে হবে করোনা আক্রান্ত হলেই যে সেই রোগী শতভাগ অচ্ছূত (চিকিত্সা পাবেন না বা দেওয়ার দরকার নেই) বা মুত্যুর মুখোমুখি তা কিন্ত নয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বারবার বলছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী কয়েকটি ধাপে (স্টেজ) বা পর্যায়ে দৃশ্যমান। প্রথম পর্যায়ে এবং মাইল্ড পর্যায়ে যারা আছেন তাদেরকে কোনো আতংকগ্রস্ত বা ভয় পাওয়ার কারণে নেই। সরকারের বিধি মেনে চললে এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে উঠবেন। প্রগেসিভ এবং সিভিয়ার পর্যায়ে যারা থাকবেন তাদেরকে চিকিত্সকের পরামর্শে হাসপাতালে চিকিত্সা নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা খুবেই আশাবাদী যে মাগুরার যে দুজনের করোনা পজিটিভ হয়েছে তারা প্রাথমিক স্তরে আছেন এবং তারা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন।
কিন্তু আমরা একটা বিষয় লক্ষ্য করছি নিজ এলাকার কেউ করোনায় আক্রান্ত হলেই আমরা নিজেরাই কিন্তু এখন যেভাবে একটা সামাজিক ও মনস্তাত্বিক চাপ তৈরি করছি তাতে করে স্থানীয় জনমনে এক ধরনের ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। আমি মনে করি এ ক্ষেত্রে সিভিল সার্জন ও স্থানীয় সাংবাদিকরা আরেকটু কৌশলী হলে সমাজে ভয় ও আতঙ্কের বিপরীতে আস্থা তৈরি হবে। ফেসবুকে যারা স্ট্যাটাস দেন তারাও যদি একটু সচেতনভাবে পোস্ট দেন তাহলেও ভয়ের বদলে জনমনে আস্থা তৈরি হবে।
অসত্য ও গুজবের সংক্রমণও কম ঘটবে। এক্ষেত্রে করণীয় হলো-
১. কেউ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন বলে শনাক্ত হলে সিভিল সার্জন অফিস থেকে সেই রোগীর শারীরিক স্ট্যাটাসটাও সাংবাদিকদের কাছে বলা, যাতে করে সাংবাদিকরা রোগীর সংখ্যার সাথে শারীরিক অবস্থার তথ্য সম্পর্কে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারেন। সেটা তুলে ধরা হলে জনমনে ভীতি কম হবে।
২. গণমাধ্যমের সাথে আক্রান্তের সংখ্যা বলার আগে কোনোভাবেই শনাক্তের সংখ্যা বাইরে প্রকাশ না করা। যাতে করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আগেই বিষয়টি সম্পর্কে চলে না আসে।
৩. আক্রান্ত রোগীদের চিকিত্সা সম্পর্কে সিভিল সার্জন অফিস থেকে নিয়মিত সাংবাদিকদের কাছে আপডেট করা। যাতে করে জনমনে কোনো গুজব তৈরি না হয়।
৪. যে বাড়িতে শনাক্ত রোগী অবস্থান করছেন সেই বাড়িতে প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবরাহ করা এবং পুলিশি নজরদারি রাখা, যাতে রোগী সঠিকভাবে আইসোলেশনে থাকে এবং কোনো ধরনের বিভ্রান্তকর পরিস্থিতি তৈরি না হয়।
৫. কারো করোনা উপসর্গ দেখা দিলে আইসোলেশনে রেখে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। আইসোলেশন সম্পর্কে আরও প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো যাতে গ্রামের আমজনতা এর গুরুত্ব ভালভাবে বুঝতে পারে এবং নিজেরাই এটির সুরক্ষা দিতে সংঘবদ্ধ থাকে। আমরা সবাই যদি করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে দায়িত্বশীল আচারণ করি তাহলে ভয় বা আতঙ্ক নয়, পরিবার ও সমাজে আরও আস্থা তৈরি হবে।
জাহিদ রহমান: সম্পাদক, মাগুরা প্রতিদিন ডটকম